রনি আকন্দ, জয়পুরহাট প্রতিনিধিঃ
একই প্রতিষ্ঠানের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে অনৈতিক প্রস্তাবের অভিযোগ উঠেছে এক ল্যাব সহকারীর বিরুদ্ধে। এমনই ঘটনা ঘটেছে জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার মোলামগাড়ীহাট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে।
অভিযুক্ত ল্যাব সহকারী মোঃ রবিউল ইসলাম উপজেলার জিন্দারপুর ইউনিয়নের কাদিরপুর গ্রামের আব্দুস সামাদ মন্ডলের ছেলে।
একই প্রতিষ্ঠানের ২ ছাত্রীকে বিবাহসহ পরীক্ষার ফলাফলের ভয়ভীতি দেখিয়ে একাধিক ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে৷ এছাড়াও শিক্ষক না হয়েও নিয়মিত পাঠদান, সরকারি বোর্ডবই নিজ কোচিংয়ে সংরক্ষণ করা, ছাত্রীদের ভাল ফলাফলের লোভ দেখিয়ে জোরপূর্বক নিজ কোচিংয়ে ভর্তি করা এবং ছাত্রীদের দিয়ে নিজের গৃহস্থালির কাজ করে নেওয়াসহ একাধিক অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে।
দীর্ঘদিন চাকুরির সুবাদে ওই প্রতিষ্ঠানেরই ৮ম শ্রেণির এক ছাত্রীকে বাল্যবিয়ে করে। কিছুদিন পরে নবম শ্রেনির আরও এক ছাত্রীর সাথে অবৈধ সম্পর্ক করে ২য় বিয়ে করেন। পরে ১ম স্ত্রীকে তালাক করেন। সম্প্রতিকালে আবারও ১০ম শ্রেনির হাবিবা নামের এক ছাত্রীকে অনৈতিক প্রস্তাব দেওয়ার ঘটনায় এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে৷
ভুক্তভোগী ছাত্রীর পরিবার ২৫ এপ্রিল বুধবার এ নিয়ে রবিউলের প্রাইভেট কোচিংয়ে গিয়ে প্রতিবাদ করলে ব্যাপক ধস্তাধস্তির ঘটনা ঘটে। এনিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে বাজারে বিচারও বসে। পরে এ ঘটনা ছড়িয়ে পড়লে এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।
সরেজমিনে গিয়ে ওই ছাত্রী ও তার পরিবারের সঙ্গে আলাপ করেন এই প্রতিবেদক। ওই ছাত্রীর মা বলেন, বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দিয়েছি যাতে আমার মেয়ে নিরাপদে থাকে। কিন্তু সেই বিদ্যালয়ের শিক্ষকই আমার মেয়েকে অনৈতিক প্রস্তাব দেয়। শুধু আমার মেয়েকেই নয়, এরকম অনেক মেয়েকেই তিনি অনৈতিক প্রস্তাব দিয়েছেন। কিন্তু ভয়ে কেউ সঠিক কথা স্বীকার করেনা। আমার মেয়ের ঘটনার কথা প্রথমে অন্য মেয়েরা বললেও সামনে পরীক্ষা হওয়ায় ভয়ে এখন আর কেউ স্বীকার করতে চাচ্ছেনা। কারণ রবিউল তাদের ফোন দিয়ে ভয় দেখিয়েছে। সাক্ষীর অভাবে তো আমরা আর বিচার পাবোনা। এজন্য আর কাউকে কোন অভিযোগ দিব না। আমার মেয়েকে আর ওই স্কুলে পাঠাব না। পরীক্ষাও দিতে দিব না। স্কুল থেকে সব মেয়েদের বলেছে কেউ যেন আমার মেয়ের সাথে কথা না বলে। বললে তোমাদের পরীক্ষায় খবর আছে। এজন্য আমার মেয়ের সাথে কেউ কথাও বলেনা। আমার মেয়ে খুব মনকষ্টে আসে। এসব ঘাটাঘাটি করে আমার মেয়ের জীবনই যদি না থাকে। ওই স্কুলের শিক্ষকরাও তারই পক্ষ নেয়। আমার মেয়েকে ওই স্কুলে দিবো যদি পরীক্ষার হলে ওই রবিউল না থাকে। প্রধান শিক্ষকের কাছে অভিযোগ করলে তিনি আমারদের বলে না এসব করো না পারলে তোমরা টিসি নিয়ে যাও।
এ বিষয়ে ভুক্তভোগী হাবিবার বাবা বলেন, গ্রামের পাশেই স্কুল হওয়ায় মেয়েকে ওই স্কুলে পড়াশোনা করাচ্ছি। আজকে আমার মেয়েকে শ্লীলতাহানি করেছে। কালকে অন্যের মেয়েকেও করবে। ওই স্কুলে আমার মেয়েকে আর পড়াব না। আমার মেয়েকে অন্য স্কুলে ভর্তি করাব। বিচার চাইতে গেলে তো সাক্ষীর প্রয়োজন হয়। প্রথমে অন্যান্যরা সাক্ষী দিতে চাইলেও পরে আর কেউ সাক্ষী দিতে চায় না৷ আমরা গরিব মানুষ যা হবার হয়ে গেছে, মেয়েকে তো বিয়ে দিতে হবে৷
সান্তনা নামের একজন ছাত্রীর মা বলেন, আমার মেয়ে ওই স্কুলের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী। রবিউল মাস্টার যেহেতু এক এক করে দুইজন ছাত্রীকে বিয়ে করেছে। আবার তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ছাত্রীকে কুপ্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। আমার মেয়ে এসব জেনে ভয়ে আর স্কুলে যাচ্ছে না। আমি চিন্তা ভাবনা করেছি মেয়েকে আর ওই স্কুলে পড়াশোনা করাব না। আমি হেডমাস্টারকে বলেছি আমার মেয়েকে যেন তাড়াতাড়ি টিসি দেয়৷
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন শিক্ষক বলেন, রবিউল একজন ল্যাব এসিসস্ট্যান্ট। দীর্ঘদিন থেকে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। ল্যাব এসিস্ট্যান্ট হওয়া শর্তেও হেডমাস্টার তাকে দিয়ে ৯ম-১০ম শ্রেণির ক্লাস করে নেন। যা মোটেও ঠিক নয়। এদিকে মাঝে মধ্যেই তার বিরুদ্ধে ছাত্রীদের সাথে সম্পর্ক করার অভিযোগ উঠে। আবার এই প্রতিষ্ঠানেরই ২ জন ছাত্রীকে তিনি বিয়েও করেছেন। যা অত্যন্ত লজ্জাজনক। এবার নাকি এক ছাত্রীকে অনৈতিক প্রস্তাব দিয়েছে। যখন এই বিষয়গুলো নিয়ে বাইরে সমালোচনা হয় তখন আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষুন্ন হয়। লজ্জায় আসাদের নাক কাটা যায়। প্রধান শিক্ষকের নিকটাত্মীয় হওয়ায় রবিউল এমন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ৷ তদন্ত করে এর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। নাহলে প্রতিষ্ঠানটি নষ্ট হয়ে যাবে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, রবিউল তার প্রাইভেট কোচিং সেন্টারের নামে একটি চাতালের গরুর সেডে প্রাইভেট পড়ান এবং তার পূর্বপাশে আরেকটি গোপন কক্ষ রয়েছে। যেখানে সরকারি নবম-দশমসহ বিভিন্ন শ্রেণীর ২০২৪ সালের বোর্ড বই সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে রেখেছেন ৷
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নবম-দশম ব্যাচের ভুক্তভোগী দুই শিক্ষার্থী বলেন, তিনি আমাদের শিক্ষক না হয়েও নিয়মিত আমাদের ক্লাস নেন। আমাদের ক্লাসের কম বেশি সব মেয়েরাই স্যারের হেনস্তার শিকার। পরীক্ষার ফলাফলের ভয়ে কেউ কিছু বলতে পারেনা। আমরা এর সুষ্ঠু বিচার চাই। তিনি সবসময় আমাদের বলেন, তার বোর্ডে হাত আছে। তিনি চাইলেই যে কাউকে পাস বা ফেল করে দিতে পারেন। পরীক্ষার হলেও তিনি অনৈতিক সহযোগিতা করতে পারেন।
নির্দিষ্ট কোনো কারণ ছাড়াই বিশেষ করে মেয়ে শিক্ষার্থীদেরকে কোচিংয়ে ছুটির পরে ভয়ভীতি (পরীক্ষার ফলাফলের) প্রদর্শনের মাধ্যমে তার নিজস্ব গোপন কক্ষে বসিয়ে রাখতে বাধ্য করা হয় বলেও তথ্য এসেছে প্রতিবেদকের হাতে।
এছাড়াও নিজের পছন্দের শিক্ষার্থীকে দিয়ে একই ব্যাচের অন্যান্য শিক্ষার্থীদের ফলাফল রেজাল্ট শীটে লিপিবদ্ধ করা। শ্রেণীকক্ষে থাকার থেকে শিক্ষকদের রুমে থাকলে ফলাফল ভালো করা যায় এ ধরণের বিভিন্ন কথা বলা। মার্কস বাড়িয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে মেয়ে শিক্ষার্থীদেরকে বিভিন্নভাবে অশালীন ও অনৈতিক ইঙ্গিত প্রদান করা,পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে তার পছন্দের শিক্ষার্থীদের অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা, ক্লাস টেস্ট এবং ব্যবহারিক পরীক্ষাসহ একাডেমিক বিভিন্ন বিষয়ে পক্ষপাতিত্বপূর্ণ আচরণ করার মাধ্যমে তার পছন্দের শিক্ষার্থীদের বেশি নম্বর প্রদান করেন। যা সর্বশেষ পরীক্ষার ফলাফলে সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়েছে।
স্থানীয়দের দাবি প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় এসব ঘটনা যেন থামছেই না বিদ্যালয়টিতে।
গুরুত্বপূর্ণ সরকারি নবম দশম শ্রেণীর বোর্ড বইগুলো কিভাবে রবিউলের হতে গেল৷ সেই বইগুলো কিভাবে কোচিং সেন্টারে সাজিয়ে রাখা হয়েছে? রবিউল একজন ল্যাব এসিস্ট্যান্ট সে কি করে ক্লাস নিতে পারে? এটি সম্পূর্ণ প্রধান শিক্ষকের যোগসাযোগে অনিয়মগুলো করা হয়েছে। সঠিক তদন্ত করলে এই প্রতিষ্ঠানের আরো অনিয়ম দূর্নীতি বেরিয়ে আসবে ৷
অভিযুক্ত রবিউল ইসলাম অভিযোগ স্বীকার করে বলেন, আমি ল্যাব এসিস্ট্যান্ট চাকরির পাশাপাশি বাজারে একটি কোচিং চালায়। সেখানে প্রায় ১২০ জন ছাত্রছাত্রীকে পড়াই। আমি যদি খারাপ হতাম তাহলে আমার কাছে এত শিক্ষার্থী পড়তে আসতো না। প্রথমে আমি বাল্যবিয়ে করেছিলাম। সেটা আমার ভুল হয়েছিল। তবে আমার ১ম স্ত্রীকে বিয়ের পরে স্কুলে ভর্তি করিয়েছি। আর ২য় স্ত্রীকে যখন বিয়ে করি তখন সে ইন্টারে পড়ত। আমি ল্যাব এসিস্টেন্ট পদে চাকরি করি, আমার ক্লাস নেওয়ার নিয়ম নাই। প্রধান শিক্ষকের অনুরোধে আমি ক্লাস নিয়েছি৷ কিন্তু ওই ছাত্রীর পরিবার মিথ্যা অভিযোগ করে আমাকে হেনস্তা করেছে। আমি দুঃখে আত্মহত্যা করতে গেছিলাম। আমার ১৫ বছরের ক্যারিয়ারে এমন কখনও হয়নি। আপনারা তদন্ত করে দেখতে পারেন ৷
এ বিষয়ে প্রধান শিক্ষক মোসাদ্দেক হোসেন বলেন, ওই শিক্ষার্থী সহ তার বাবা মা আমার কাছে মৌখিক অভিযোগ করেছিল। আমি উনাদেরকে লিখিত অভিযোগ করতে বলেছিলাম। তারা লিখিত অভিযোগ করেনি। এমন কোন নিয়ম নেই যে ল্যাব এসিস্ট্যান্ট ক্লাস নিতে পারবেনা। কারিগরি শিক্ষক না থাকায় তাকে দিয়ে ক্লাস করানো হয়েছে। আর তার ১ম বউ বিয়ের পরে এখানে ভর্তি হয়েছিল এবং ২য় বউ স্কুল থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর বিয়ে করেছে।
এছাড়াও তদন্ত করে দোষী প্রমাণিত হলে তাকে চাকরিচ্যুত করা হবে৷ কোচিং সেন্টারে বই রাখার ব্যাপারে তিনি বলেন, বইতো সে সেখানে রাখতে পারেনা।
কালাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবুল হায়াত জানান, এই অভিযোগটি কোন এক মাধ্যমে আমাদের কাছে এসেছে। আমরা তদন্ত শুরু করেছি৷ তদন্ত শেষে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে ৷