সোহরাব বরগুনা সংবাদদাতাঃ
শোকের মাসে স্মৃতির পাতায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাংবাদিকদের বললেন, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি, বরগুনা-১ আসনের সংসদ সদস্য, অ্যাডভোকেট ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু এমপি তিনি বলেন বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ- এ দুটি নাম একে অপরের পরিপূরক। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের কালরাতে তাকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এই বিভীষিকাময় হত্যাকাণ্ডের কথা আমার যতবারই মনে পড়ে, ততবারই বুক ডুকরে কেঁদে ওঠে। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছি।
১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আগমন উপলক্ষে আমার সহপাঠী ও বন্ধু শেখ কামাল ভাইসহ মাঝরাত অবধি আমরা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দলবেঁধে কাজ করেছিলাম। কাজের এক ফাঁকে রাত নয়টার দিকে প্রিয় অনুজ, বরগুনা জেলার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবদুর রশীদকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি ও পানিসম্পদমন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায় গিয়ে দীর্ঘক্ষণ ছিলাম। বঙ্গবন্ধু তখন বাকশালের বিভিন্ন ফ্রন্ট গঠন করছেন। আমি বরগুনাতে যুবলীগ বা শ্রমিক লীগ যে কোনো একটা ফ্রন্টের চেয়ারম্যান হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলাম। সেরনিয়াবাত সাহেব আমাকে যে কোনো একটা ফ্রন্টের দায়িত্ব দিতে চেয়েছিলেন। এ নিয়েই দেখা করতে গিয়েছিলাম।
সেখানকার কাজ শেষ করে রাত একটার দিকে সলিমুল্লাহ হলে কামাল ভাইয়ের সঙ্গে পুনরায় একত্রিত হই। রাত দুটার দিকে শেখ কামাল ভাই বাসায় চলে যেতে উদ্যত হলে, আমরা যারা তার সঙ্গে ছিলাম, না যাওয়ার অনুরোধ করে বলেছিলাম, আপনি যাবেন না, আমরা ভোরবেলা আপনাকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানাতে চাই। কিন্তু তিনি জানালেন তাকে যেতেই হবে বাসায়।
মৃত্যুর মাত্র আড়াই-তিন ঘণ্টা আগেও তিনি আমাদের সঙ্গে ছিলেন! শেখ কামাল ভাই চলে যাওয়ার পর আরও কিছু কাজ করে রাত প্রায় তিনটার দিকে রুমে এসে ঘুমাতে যাই। তেমন একটা ঘুমাতে পারিনি, এর মধ্যে খুব ভোরে হরিমানিক্য দত্ত নামে এক বন্ধু আর্তনাদের সুরে ডেকে আমার ঘুম ভাঙাল। উদ্বেগজড়িত কণ্ঠে সে বলছিল, দাদা, ওঠেন ওঠেন, বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলেছে। তখন আমি জগন্নাথ হলের ইস্ট হাউসের দোতলায়। এখান থেকে পেছনে তাকালেই জগন্নাথের মাঠ। সেখানে তখন পুলিশ, আনসার সদস্যরা প্যারেড প্র্যাকটিস করছিল বঙ্গবন্ধুকে গার্ড অব অনার দেওয়ার জন্য। হরিমানিক্যের কথাটা তাই কিছুতেই বিশ্বাস হলো না।
ওকে বললাম, যাও এটা কিছুতেই হতে পারে না। প্যারেড প্র্যাকটিস দেখিয়ে ওকে বলতে চাইলাম দেখছ না বঙ্গবন্ধুকে গার্ড অব অনার দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। আমাকে থামিয়ে দিয়ে সে বলে, ওরা এখনো জানে না। এর মধ্যে হলের অনেকেই দৌড়াদৌড়ি করে বেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তখনো আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না যে, বঙ্গবন্ধু আর নেই! রুমে ছোট একটি রেডিও ছিল। আমি রেডিও অন করলাম। রেডিওতে ততক্ষণে মেজর ডালিমের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে, আমি মেজর ডালিম বলছি, শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। বলে কী? এ-ও কি হতে পারে? পাকিস্তানি ঘাতকরা সহস্র ষড়যন্ত্র করে, বিচারের নামে প্রহসন করেও যাকে হত্যা করতে পারেনি, সেই বঙ্গবন্ধুকেই স্বাধীন বাংলাদেশে হত্যা করা হয়েছে? এটি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
তখন আমার চোখে ভাসছিল ১৯৭৩ সালের পহেলা জানুয়ারির স্মৃতি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেবার বঙ্গবন্ধু প্রথমবার বরগুনা সফরে গিয়েছিলেন। বরগুনায় তখন প্রায় দুই থেকে আড়াই মাইল জায়গা নিয়ে তখন বিশাল একটা মাঠ ছিল। ওই মাঠে বঙ্গবন্ধুর আগমন উপলক্ষে আমরা জনসভার আয়োজন করেছিলাম। আমি তখন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। ঢাকাতেই থাকি বেশিরভাগ সময়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বরগুনা আসবেন এজন্য ৮-১০ দিন আগেই বরগুনা চলে আসি। এসে তৎকালীন ছাত্রনেতা সিদ্দিকুর রহমান, বরগুনা মহকুমার তৎকালীন ছাত্রলীগ সভাপতি জাহাঙ্গীর কবীরসহ আরও কয়েকজনকে নিয়ে পরিকল্পনা করি, আমরা ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে বিশেষ কিছু করব, যেটা দেখে বঙ্গবন্ধু খুশি হবেন। পরিকল্পনা অনুসারে আমরা তখন বঙ্গবন্ধুর জন্য খড়কুটো, বাঁশ দিয়ে খুব সুন্দর একটা কুটির নির্মাণ করেছিলাম।
বঙ্গবন্ধু হেলিকপ্টার থেকে নামার পর আমরা তাকে কুটিরে নিয়ে যাই। কুটিরে তাকে নিয়ে যাওয়ার পর আমি, জাহাঙ্গীর কবীর, সিদ্দিকুর রহমানসহ কয়েকজন বঙ্গবন্ধুর পায়ের কাছে বসি। সেখানে বসে তিনি পিঠা খান। বঙ্গবন্ধুর জন্য আমাদের মায়েরা হরেকরকমের পিঠা তৈরি করেছিলেন। পিঠা খাওয়ার সময় আমাদের উদ্দেশ করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এই তোরা পিঠা নে। তার পর তিনি নিজের হাতে পিঠা দিয়েছিলেন আমাদের। সেই স্মৃতি কি ভোলার মতো? আমাদের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে আমি, জাহাঙ্গীর কবীর আর সিদ্দিকুর রহমানও বঙ্গবন্ধুকে হেলিপ্যাড পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গেলাম। হেলিকপ্টার যখন আকাশে ফ্লাই করছিল তখনো আমি, সিদ্দিকুর রহমান আর জাহাঙ্গীর কবীর বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ করে সালাম আর স্লোগান দিচ্ছিলাম। হেলিকপ্টার আকাশে উঠেও গেছে অনেকটা, এমন সময় বঙ্গবন্ধু তোফায়েল ভাইকে বললেন, এই তোফায়েল হেলিকপ্টার নামাতে বল, ওই যে স্লোগান দিচ্ছে ছেলে তিনটা, ওরা তো আমার সঙ্গে সঙ্গে ছিল, আপ্যায়ন করেছে, ওদের সঙ্গে তো কথা বলে আসি নাই। হেলিকপ্টার নিচে নেমে এলে আমাদের তিনজনকে ডাক দিয়ে এবং হাত দিয়ে ইশারা করা হলো কাছে যেতে। সে এক মাহেন্দ্রক্ষণ। কাছে গেলাম। তখন বঙ্গবন্ধু আমার হাতে কিছু টাকা দিয়ে বললেন, তোরা কিছু খাওয়া-দাওয়া করিস। বঙ্গবন্ধুর এই দৃশ্যটাই তখন আমার চোখে ভাসছিল বারবার। এ ছাড়া আর মনে পড়ছিল, নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের মাত্র দুই দিন আগের ১২ আগস্টের কথা। সেদিন বিকালে ওবায়দুল কাদের ভাই, আশরাফুল ভাইসহ আমরা ৮-১০ জন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা গিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে আশীর্বাদ আর দিকনির্দেশনা নিয়ে এসেছিলাম। আমরা ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা সেদিন ২ ঘণ্টারও বেশি সময় বঙ্গবন্ধুর পায়ের কাছে বসেছিলাম। সেই কথাও মনে পড়ছিল! এ স্মৃতিগুলো মনে পড়ছিল আর চোখ ভেসে যাচ্ছিল অশ্রুতে! এসব ভাবতে ভাবতেই আমি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। দ্বিধাগ্রস্ত মনেই সকাল সাড়ে সাতটার দিকে হল থেকে বেরিয়ে পড়লাম। তার পর ছাত্রলীগের অন্য নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এমপিদের বাসার দিকে রওনা দিলাম। কিন্তু কোনো দিকনির্দেশনা পেলাম না। ওইখানে ছাত্রলীগের কয়েকজন ছিল। ওদের ডাকলাম। সেখানে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য এবং পরবর্তীকালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া শাহ মোহাম্মদ আবু জাফরকেও পেলাম। সে আমাকে বলল, চল দোস্ত, ড্রাম ফ্যাক্টরির ওদিকে যাই। তখন সব এলোমেলো, ছন্নছাড়া হয়ে গেছে। আমরা কজন মিলে ড্রাম ফ্যাক্টরির সামনে যেখানে এখন বিআরটিএর অফিস সেখানে গিয়ে রাস্তার কোনায় দাঁড়াই। ওখানে দেখি কিছু বাঙালি আর বিহারি মিলে একটা দল পাকিয়েছে। তাদের টার্গেট হলো এমপি হোস্টেল লুট করা।
আমি আর জাফর মিলে তখন সিদ্ধান্ত নিলাম যে, ওদের এখান থেকে হটাতে হবে। নইলে একটা বিশৃঙ্খলা শুরু হয়ে গেলে সেটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। ওদের ছত্রভঙ্গ করতে প্রথমে আমরা কজন মিলে ইটপাটকেল ছুড়লাম। পরে আমাদের সঙ্গে উপস্থিত জনতার অনেকে এসে যোগ দিল। ঘটনার আকস্মিকতায় কিছু বুঝতে না পেরে ওরা যে যেদিকে পারে সেদিকে ছুট দিল। সারাদিন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে খাওয়া-দাওয়া না করে আমরা দিগি¦দিক ছোটাছুটি করলাম। তখন বারবার মনে হচ্ছিল, মুক্তিযুদ্ধে বাবাকে হারিয়ে এতিম হওয়ার মতো বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে আরও একবার এতিম হলাম।
এমন অবস্থায় মানসিকভাবে আরেকটি যুদ্ধের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে করতে আগস্টের ১৭ তারিখ ঢাকা থেকে বরগুনার উদ্দেশে রওনা হলাম। আমি বরগুনা পৌঁছে দেখি এসডিও সিরাজউদ্দীন সাহেব ও এসডিপিও ফারুক সাহেবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, মুক্তিযোদ্ধা, কমিউনিস্ট পার্টির সমন্বয়ে একটা প্রতিরোধ শুরু হয়ে গেছে। তারা সেখানে মোশতাক সরকারের কারফিউ জারি করতে দেয়নি।
বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে সারা দেশের ভেতরে যেটা একই সঙ্গে প্রথম প্রতিবাদ এবং বিদ্রোহ ছিল। এখানে আমাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে রক্ষীবাহিনীও তাদের অস্ত্র জমা দেয়নি। আমি এসে তাদের সঙ্গে যোগ দিলাম আর মনে মনে স্রষ্টার কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলাম, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে সশরীরে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পেয়ে। আমরা এখানে টানা আট দিন খুনি মোশতাক সরকারের কার্যক্রম থেকে সবকিছুকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে পেরেছিলাম। তখন একেকটা দিন আমরা শহরের জ্ঞানরঞ্জন ঘোষের বাড়িতে বসে মিটিং করতাম, প্রতিবাদের যাবতীয় কর্মসূচি ঠিক করতাম আর আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে রাস্তায় রাস্তায় স্লোগান দিতাম, মুজিব হত্যার বিচার চাই, খুনি মোশতাক সরকারের শাসন মানি না, মানব না। এভাবে সপ্তাহব্যাপী আন্দোলন চলার মধ্যে আমরা যারা আন্দোলনে প্রবলভাবে সক্রিয় ছিলাম। জাতির পিতাকে হত্যার প্রতিবাদ করায় খুনি মোশতাক সরকার গ্রেপ্তার করে আমাকে। পঁচাত্তর থেকে আটাত্তর পর্যন্ত জীবনের চরম দুঃখের দিন। তিন বছর অন্যায়ভাবে আটক থাকার পর জেল থেকে মুক্ত হই।
শোকের মাসে বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। স্মরণ থেকে প্রতিষ্ঠিত হোক প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের এক পরিপূর্ণ দেশ গড়ার প্রত্যয়। বঙ্গবন্ধুর আদর্শগুলো কল্যাণকর আদর্শ হিসেবে অতীতে বিবেচিত হয়েছে, বর্তমানে হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও বিবেচিত হবে। তাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও চেতনা আমাদের সবাইকে ধারণ করে স্বপ্নের বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।